নাহিদ ধ্রুব’র দশটি কবিতা
এই তো জীবন
এসেছি পাতার মতো বাতাসের সাথে
ট্রেন তবু লেট করে এলো মাঝরাতে
টহল মেঘের দল এখনও সজাগ—
তারায় খচিত আছে আশাবরী রাগ
তক্ষকের ডাক শুনি, প্লাটফর্ম ফাঁকা
বিস্মৃত জীবন যেন জলরঙে আঁকা
তাকাবো না ভেবে ফিরে বারবার দেখি
সমস্ত জীবন ছিল কতখানি মেকি
অতর্কিত বৃষ্টি এসে ভেঙে দেয় মোহ—
প্রতিটি ফোটায় যেন মিশে গেছে দ্রোহ
নীরবতা ভাঙে শোনা যায় হুইসেল
ফেরারি হয়েছি ভেঙে জগতের জেল
জীবন চলেছে কবে নিশ্চয়তা মেনে?
টিকিটবিহীন আমি উঠে বসি ট্রেনে…
যেখানে যাওয়ার যাবো, প্রশান্ত এ মন
ক্লান্তি নেই, তাড়া নেই, এই তো জীবন
কনস্ট্যান্ট
হিমায়িত চাঁদ, ঘোলাটে আকাশ, ভীষণ সর্বনাশ
আস্কারা পেয়ে খামোশি এনেছে ঝড়ের দীর্ঘশ্বাস
এলোমেলো হাঁটি, মাতালের মতো হাওয়ার আকর্ষণে
পথে পথে কতো, সজারুর কাঁটা, বিঁধে যায় এই মনে
বেদনা প্রবণ আঁধারের থেকে যত দূরে যেতে চাই—
ফোবিয়ার মাঝে মেঘগুলো আসে ঘুরেফিরে অযথাই
ঘুম আসে চোখে, তবু জেগে রই, ঝরে যেতে দেখি পাতা
চোখের আড়ালে, কলকাঠি নাড়ে, গভীর বিষন্নতা
নভোচারী
সে এমন নভোচারী— চাঁদে হাঁটতে হাঁটতে যার মন পড়ে থাকে শিমুল বনের জ্যোৎস্নায়।
সহযাত্রী
স্ট্রিট সিঙ্গার গাইছে, ঠিক তার পাশে সাপুড়ে দেখাচ্ছে খেলা। দূরে বসেছে হাউজি, সেখানেও মানুষের মেলা। দড়িও প্রস্তুত, এইতো এখনই হেঁটে যাবে সার্কাসের মেয়ে— এসবের মাঝে কেউ একজন বসে আছে উদগ্রীব হয়ে। একা। তার প্রেমিকার নাম হয়তো সুলেখা। যার জন্য আছে সে অপেক্ষারত— কিংবা হয়তো সে আমারই মতো। মানুষের মাঝে খোঁজে নির্জনতা, ভুতুড়ে জ্যোৎস্না রাতে— ভাবি, কী কী কথা বলতাম, যদি পরিচয় হতো তার সাথে! কোথা থেকে এলো, বাড়িতে কে আছে, আসলে কী করে— এইসব? মনে মনে ভেবে নেই, এ জগতে কেউ নেই, করি তার ব্যথাগুলো অনুভব। কাছে যেতে ভয় হয়, ঘন হয়ে আসে আরও রাত্রি— ধরে নেই, দুঃখী সমস্ত মানুষ একই পথের সহযাত্রী…
দুর্বিপাকে
তোমায় আমি দুঃখের কথা বলবো না আর
তুমুল ঝড়ের পাল্টা আঘাত সইবে কত?
প্রতিজ্ঞা সব চাইলে এখন ভুলতে পারি—
দুঃখগুলোই, থাকুক না হয় অবিক্ষত।
মুখরতার মাঝে ভীষণ স্তব্ধ থাকি,
পৃথিবীর সব গল্প যেন আমার শোনা—
হাওয়ার কানে, পাঠ করে যাই, মন্ত্র সুখের
নিজের বেলায় করতে পারি প্রবঞ্চনা।
আজ আমাদের এই যোগাযোগ বৈধ নয়
ভুলের দলিল দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়ে থাকে,
কী হলে কী, হতে পারতো, বলার আগে
তোমায় আবার হারায়ে ফেলি দুর্বিপাকে…
সে এখন কতদূর
ঝোঁপের আড়ালে পড়ে থাকা ভাঙা বাঁশি— আমি তোমারেই বাজাতে এখানে আসি। তুমি তা জানো না, হয়ে ওঠো কৌতুহলী— পাখিদের সোহবতে, হয়তো ফুলের মতে, খেলছি গানের কলি। আশেপাশে কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু হাওয়া আর হাওয়া— চারিদিকে মেঘের উস্কানি তবু কোথাও হয় না যাওয়া। বসে ভাবি, কে এখানে ফেলে গেছে ভাঙা বাঁশি— সে এখন কতদূর? বাজাতে পারি না বাঁশি, তবু চারিদিকে এতো সুর, এতো সুর…
ভ্রমে
কতো যে ছায়াপথ মনে মনে
পেছনে ফেলে এসে ভুলে যাই
বিস্ময় এখনও নির্জনে
আমাকে ডেকে বলে মরো নাই!
হারায়ে গেছে কবে নটরাজ
ছেঁড়া তারে তবুও বাজে বীণা
নিষুপ্ত বাগান খোলে ভাঁজ
খোঁড়া ফুলেরা নাচে ব্যালেরিনা
কিছুই তো থাকে না চিরদিন
দাবানলে পুড়ছে বনভূমি
ভ্রমে থাকাই যেন সমীচীন
ধরি এখনও পাশে আছো তুমি
কবর নেই, আছে এপিটাফ
সহসা কতো লাশ তাড়া করে
নিজেরে দিই আমি অভিশাপ
গোরস্থান যেন দ্রুত মরে
পরবাসী
দেখা হবে এই ভেবে আজও
তোমার শহরে ফিরে আসি—
কতোটা পৃথক হলো পথ,
কতটুকু হলে পরবাসী?
দেখা হবে এই ভেবে আজও
চৈতন্যে জ্বলতে থাকে ধূপ—
নীল আলো পড়ে বনতলে
এ শহর লাগে অপরুপ;
যদিও তোমার দিক থেকে
সাড়া নেই, সাড়া নেই কোন,
পথে ও বিপথে করি গান—
হাওয়াদের বুকে বাজে শোন
প্রতিশ্রুতিহীন মেঘ ওড়ে—
প্রতারণা করে আজ ঝড়,
এ শহর ডুবে যায় জলে
পাতারাও কাঁপে থরথর
ভেঙে গেছে সবগুলো সাঁকো
কী করে করবে পারাপার—
জানি তুমি নিরুপায় খুব,
ভেসে যাওয়া নিয়তি আমার…
অবতলে
অদ্বৈত ডুমুর গাছে কতো পাখি বসে আছে
মনে মনে করে প্রাণায়াম
ডাকে পাখি কলস্বরে কেঁপে কেঁপে উঠি জ্বরে
চোখে ভাসে বহুরূপী গ্রাম
জেল হয়ে আছে ঘর অতলান্ত চরাচর
অবাধ্য মেঘের ডাক শুনে
ব্যর্থ বাউলের মতো হেঁটে যাই অবিরত
শুকনো নদীর ঢেউ গুনে
সম্মোহিত হয়ে থাকি হাওয়াদের ছবি আঁকি
কারে যে করবো আমি দায়ী
কতো কী করার ছিল বেদনা কতোটা নিলো
নিজেরেই ভাবি আততায়ী
হাতে নিয়ে ছেঁড়া পাল হয়ে কিছুটা মাতাল
নিজের অতীত দেখি জলে
জীবন হয়তো খেলা করে সব অবহেলা
আমি ডুবে যাই অবতলে
জরা
যেন তুমি সে’ই জন্মদাগ, যায় না উপেক্ষা করা
বুঝি আর কিছু নয়, আমারে পেয়েছে শুধু জরা